
ভূমিকা
নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ডাকে নয়, বরং দেশের তরুণ প্রজন্ম, অর্থাৎ ‘Gen Z’ আন্দোলনের নেতৃত্বে, সংঘটিত হলো এক নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান। সরকারের সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিবাদ মুহূর্তেই রূপ নেয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক গণবিস্ফোরণে। সপ্তাহব্যাপী চলা সহিংসতায় বহু হতাহতের পর অবশেষে পতন ঘটে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সরকারের।
যে সিদ্ধান্তে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন: সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধকরণ
এই সংকটের সূত্রপাত হয় যখন নেপাল সরকার Facebook, YouTube, TikTok, Instagram ও X (সাবেক Twitter) সহ ২৬টি জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধের ঘোষণা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়, এই প্ল্যাটফর্মগুলো স্থানীয় আইন মেনে নিবন্ধন করেনি এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম এটিকে তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এক নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে। তাদের কাছে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো কেবল বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, বরং জ্ঞান অর্জন, যোগাযোগ এবং প্রতিবাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল। এই সিদ্ধান্তই তাদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজপথে নামতে বাধ্য করে।
.webp)
কেন এই গণঅভ্যুত্থান? শুধু কি ইন্টারনেট?
বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, এটি শুধু ইন্টারনেট ফিরে পাওয়ার লড়াই। কিন্তু এর গভীরে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ আর বঞ্চনার গল্প। নেপালের এই রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলো হলো:
- দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: সাধারণ মানুষ যখন অর্থনৈতিক চাপে জর্জরিত, তখন রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের ছবি ও ভাইরাল ভিডিও তরুণদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। এই ডিজিটাল বৈষম্যই তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে সিস্টেম কতটা ভেঙে পড়েছে।
- অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্ব: উচ্চশিক্ষা শেষ করেও চাকরির অভাব দেশের যুবসমাজকে হতাশ করে তুলেছিল। সরকারের প্রতি তাদের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল।
- ডিজিটাল অধিকার হরণ: Gen Z প্রজন্মের কাছে ইন্টারনেট একটি মৌলিক অধিকারের মতো। তাদের কণ্ঠস্বর রোধ করার এই প্রচেষ্টা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের শেষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে।
উত্তাল রাজধানী এবং ভাইরাল হওয়া মুহূর্তগুলো
রাজধানী কাঠমান্ডুর রাজপথ হাজার হাজার তরুণের স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের বেশ কিছু মুহূর্ত নেপালের ভাইরাল নিউজ হিসেবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রতিবাদের তীব্রতাকে সবার সামনে তুলে ধরে:
.webp)
- পুলিশের গুলিতে আহত এক তরুণের রক্তাক্ত শার্ট পরেও মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণামূলক দৃশ্য।
- গণরোষ থেকে বাঁচতে রাজনীতিবিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হেলিকপ্টারে করে পালানোর নাটকীয় এবং প্রতীকী ছবি।
- বিক্ষুব্ধ জনতার দ্বারা সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা।
সরকারের পতন ও দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি
দেশব্যাপী তীব্র বিক্ষোভ, সহিংসতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকার প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়া উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। কিন্তু ততদিনে আন্দোলনকারীদের দাবি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। অবশেষে, প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

নেপালের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীল কাঁর্কির নাম সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনায় রয়েছে। তবে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি এবং রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
উপসংহার
নেপালের এই Gen Z আন্দোলন প্রমাণ করেছে—ডিজিটাল যুগে তরুণ প্রজন্মের সম্মিলিত শক্তিকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। এটি শুধু একটি সরকার পতনের ঘটনা নয়; বরং এটি বিশ্বজুড়ে তরুণদের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা: যখন দুর্নীতি, অবিচার ও স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন ইতিহাস বদলে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকে।