ফেসবুক পোস্ট ঘিরে হাটহাজারী রণক্ষেত্র: কওমি-সুন্নি সংঘর্ষে আহত শতাধিক, ১৪৪ ধারা জারি

স্মার্ট বার্তা ডেস্ক - ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হাটহাজারীতে কওমি-সুন্নি সংঘর্ষের দৃশ্য

ফেসবুকে এক যুবকের দেওয়া অবমাননাকর পোস্টকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ কওমি মাদ্রাসা আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম (হাটহাজারী মাদ্রাসা)-এর সামনে অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে তোলা ছবি পোস্ট করার জেরে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কওমি অনুসারীদের সঙ্গে সুন্নি মতাদর্শীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।

দিনভর উত্তেজনা, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সড়ক অবরোধ এবং যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনায় পুরো এলাকা থমথমে হয়ে পড়ে। সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং আরও প্রাণহানি এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন পৌর এলাকার দুটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ১৪৪ ধারা জারি করেছে।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকালে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে চট্টগ্রামে আয়োজিত জশনে জুলুসে (ধর্মীয় শোভাযাত্রা) যোগ দিতে যাওয়ার পথে আরিয়ান ইব্রাহিম নামের এক যুবক হাটহাজারী মাদ্রাসার সামনে দাঁড়ান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার দিকে অবমাননাকর অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুলে নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন। পোস্টটি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থী এবং অনুসারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

হাটহাজারীতে সংঘর্ষ পরবর্তী পরিস্থিতি

দিনভর উত্তেজনা ও সংঘর্ষ

সকালের এই ঘটনার পর দিনভর চাপা উত্তেজনা বিরাজ করে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মাইকে একাধিকবার শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানায়। তবে সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। জশনে জুলুস থেকে ফেরার পথে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এসময় কয়েকটি বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। এতে পুরো এলাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় এবং জনমনে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

সংঘর্ষে আহতদের হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। গুরুতর আহত প্রায় ৩০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে।

অভিযুক্ত যুবক আটক

ঘটনার জেরে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যেই পুলিশ অভিযুক্ত যুবক আরিয়ান ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তারে অভিযানে নামে। ফটিকছড়ি থানা পুলিশ শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফটিকছড়ি পৌর সদর থেকে তাকে আটক করে। আটকের পর একটি ভিডিও বার্তায় ওই যুবক তার কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায়।

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, "এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

প্রশাসনের পদক্ষেপ ও ১৪৪ ধারা জারি

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সন্ধ্যায় পুলিশ ও র‍্যাবের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মো. তারেক আজিজ জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

হাটহাজারীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান

পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শনিবার রাতে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে ১৪৪ ধারা জারির আদেশ দেন। আদেশ অনুযায়ী, শনিবার রাত ১০টা থেকে রোববার বিকেল ৩টা পর্যন্ত এ ধারা বলবৎ থাকবে।

যেসব এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে:
১. মীরেরহাট বাজার থেকে এগারো মাইল সাবস্টেশন পর্যন্ত এলাকা।
২. উপজেলা পরিষদ গেট থেকে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট পর্যন্ত এলাকা।

এই সময়ে উল্লিখিত এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণজমায়েত এবং পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির একত্র চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি সকল প্রকার দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র বহনও নিষিদ্ধ।

ইউএনও মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন গণমাধ্যমকে বলেন, "জনসাধারণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা এবং শান্তি-শৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।" তিনি কোনো তৃতীয় পক্ষকে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফায়দা হাসিলের সুযোগ না দেওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট পড়ুন

Post a Comment

Previous Post Next Post