বিশেষ প্রতিবেদন, ৭ আগস্ট ২০২৫:
পাঁচটি বছর। এক হাজার আটশ পঁচিশটি দীর্ঘ প্রহর। সংযুক্ত আরব আমিরাতের তপ্ত মরুতে প্রবাসী বাহার উদ্দিন (৩৫) প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছেন শুধু একটি স্বপ্নের ছবি বুকে নিয়ে— দেশে ফিরবেন, আর জড়িয়ে ধরবেন তার প্রিয়জনদের। অবশেষে সেই দিনটি এলো। গত ৩ আগস্ট, রবিবার, দেশের মাটিতে পা রাখলেন তিনি, হাতে ছিল মা, স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য জমানো টাকায় কেনা উপহার। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যে ঘরে ফেরার জন্য তার এই দীর্ঘ অপেক্ষা, সেই ঘরটাই পরিণত হয়েছে এক নিঃসীম শূন্যতায়।
এক নিমিষে শেষ স্বপ্নের যাত্রা
ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায়,
ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগে। বাহারকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বরণ করে আনতে তার পুরো পরিবার একটি ভাড়া করা মাইক্রোবাসে করে নোয়াখালীর চাটখিল থেকে রওনা দিয়েছিল। সেই আনন্দযাত্রায় ছিলেন বাহারের মা নুরজাহান বেগম (৬০), তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার (৩০), তাদের তিন সন্তান—কামরুল হাসান (১০), ইব্রাহিম (৭) ও ছোট্ট আফিফা (৪), এবং শ্যালক সাইফুল ইসলাম (২২)।
কিন্তু তাদের স্বপ্নযাত্রা মাঝপথেই থেমে যায়। বিপরীত দিক থেকে দানবের মতো ছুটে আসা একটি নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক সরাসরি আঘাত হানে তাদের মাইক্রোবাসে। সংঘর্ষ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ছয়জন, হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় আরও একজনের। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত হন মাইক্রোবাসের চালক আবদুল কাদেরও (৪০)।
স্বপ্নভঙ্গের করুণ প্রতিচ্ছবি
বিমানবন্দরে নেমে বাহার যখন তার পরিবারকে ফোন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি জানতেন না যে তার জন্য কী ভয়ংকর সংবাদ অপেক্ষা করছে। একটি ফোন কলেই তার পুরো পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে যায়। যে মানুষটি পাঁচ বছর পর ভালোবাসার মুখ দেখার জন্য ফিরেছেন, তাকেই নিজের হাতে শনাক্ত করতে হলো তার প্রিয়জনদের নিথর দেহ।
বাহারের চোখে যে স্বপ্নগুলো ভেসে বেড়াচ্ছিল, তা এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল। তার কেনা উপহারগুলো আজ পড়ে আছে, কিন্তু সেগুলো নেওয়ার মতো আর কেউ বেঁচে নেই।
একটি গ্রাম, সাতটি কবর
এই মর্মান্তিক খবর নোয়াখালীর চাটখিলে তাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই সেখানে শোকের মাতম শুরু হয়। যে বাড়িতে বাহারের ফেরার অপেক্ষায় উৎসবের আমেজ ছিল, আজ সেখানে শুধুই কান্নার রোল। বাড়ির উঠানে পাশাপাশি খোঁড়া হয়েছে সাতটি কবর। প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন।
হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ঘাতক ট্রাকটি আটক করা গেলেও এর চালক পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।
শেষ কথা:
বাহার উদ্দিনের এই গল্প শুধু একটি পরিবারের দুর্ভাগ্য নয়, এটি আমাদের দেশের অনিরাপদ সড়কের এক করুণ বাস্তবতা। যে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন, তাদের পরিবারের নিরাপত্তাটুকুও আমরা নিশ্চিত করতে পারি না। এই ঘটনা আমাদের সড়ক ব্যবস্থার দুর্বলতাকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
পাঠকের কাছে প্রশ্ন: এই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রোধে আপনার মতে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত? নিচে কমেন্টে আপনার মতামত আমাদের জানান।
দৈনিক ইনকিলাব, যুগান্তর, মানবজমিন, বাসস, আরটিভি অনলাইন
News Source:
BSS (Bangladesh Sangbad Sangstha)
RTV Online